১ম বর্ষ,৫ম সংখ্যা,১৫ ই জুন ,২০১৪। ১লা আষাঢ়,১৪২১

১ম বর্ষ,৫ম সংখ্যা,১৫ ই জুন ,২০১৪। ১লা আষাঢ়,১৪২১

Sunday, June 15, 2014

বৃষ্টি এবং বানে


বৃষ্টি এবং বানে
__কামরুল আরেফিন __

আজ বিকালে ঝড়ে
দাদুর কুড়ে ঘরে
হিংস্র আঘাত হানে
বৃষ্টি এবং বানে ।
জীর্ণ কুড়ের চাল
ছিলো টালমাটাল
উড়ে নিলো শেষে
ডাইনী হেসে হেসে ।
পাষাণ রকম কান্ড
ভাংলো নানা ভান্ড
বালিশ কাঁথা ভিজে
অবস্থাটা কীযে !
করবে কী আর দাদু
ভাবছে কাঁদু কাঁদু
নেইতো কামাই রুজি
ঘর হবে না বুঝি ।

চাপা হাসির রোল


চাপা হাসির রোল

মেহেদী হাসান

শীতকালের সকালবেলা।
ঘিঞ্জি গ্রাম, নিকট দিয়ে এঁকে বেঁকেবয়ে চলা ছোট নদী, লাগোয়া পাকা সড়ক;  কুয়াশা ভেদ করেএকটি বেকারিভ্যানকেবেশ আয়েশ করে চালিয়ে নিয়ে আসতে দেখা যায়জীর্ণশীর্ণগোছের একটি চ্যাংড়া ছেলেকে
বেকারী ভ্যানটি বড়সড় একটি মনোহারী দোকানের কাছাকাছিচলে আসে, ছেলেটির প্যাডেল মারা বন্ধ হয় দোকানদারের হাহাকার ভরা কন্ঠ, মাথায় প্যাঁচানো মাফলার ভেদ করে, তার কানে এসে ঢোকে কোন বিষয়ে কথা হচ্ছে তা সে স্পষ্ট শুনতে না পেলেও, কথা বলার আবেগাক্রান্ত ভাবে,এটুকু শুধু বুঝতে পারে যে, দোকানদার তারকোন এক সুহৃদের সাথে বড় ধরনের কোন দুঃখেরব্যাপার নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেছে
ভ্যানটি মন্থর গতিতে এগিয়ে এসে দোকানটির সামনে পৌছায়, কড়া ব্রেক কষেচ্যাংড়া ছেলেটি সিট থেকে নেমে পড়ে, দোকানের ভেতরে তাকায়- কি কি মাল দোকানে মজুত আছে আর কি কি মাল দিতে হবে সেই হিসাব কষতে। শিশির ঝরার মতদোকানদারের মুখ থেকে বের হয়ে আসতে থাকাকথাগুলো এবারক্রমে ক্রমে তার কাছেসুস্পষ্ট হয়ে উঠেকিভাবে সেপোল্ট্রি মুরগীর কারবারে গিয়েবড় ধরনের মার খেয়েছে, দোকানদারের হতাশ কন্ঠে তারই ম্লানবর্ণনা-সুহৃদের মুখোমুখি বসেছেলেটি, শুনতে শুনতেই, ভ্যানেরপিছন দিকের পাল্লা খুলে বেকারী সামগ্রী বের করার কাজে হাত লাগায়; কাজের এক ফাঁকে, আড়চোখে মানুষ দুটির দিকে আবার একনজর তাকিয়ে নেয়
শীতকালে পেট্রোলিয়াম জেলি না মাখলে মুখের চামড়া যেমন চড়চড়ে হয়ে থাকে, দোকানদারের চোখেমুখে সহানুভূতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তেমন ধরনে পরিস্ফুট আর সুহৃদ ব্যাক্তিটির মুখে, লেগে থাকা আবেগের লঘুভাবকে থমথমে অবস্থায় রুপান্তরের, একটি কষ্টকর প্রচেষ্টা- নিজের আর্থিক ক্ষতির কথা উজাড় করতে থাকা লোকটি বাদে যে কেউ একবার তাকানোতেই ধরে ফেলবে সুহৃদ ব্যাক্তিটিদোকানদারের বলতে থাকা কথার ফাঁকফোকরেছোট ছোট আহহারে! ইশ! হায় হায়! নানা ধরনের সহানুভূতিসূচক শব্দ এমনভাবেউচ্চারণ করছে যেন মুখের চড়চড়ে চামড়ায় আলতো হাতে পেট্রোলিয়াম জেলি মেখে দিচ্ছে।লোকটির মুখে লেগে থাকা অসহায়ত্বের চড়চড়ে ভাব সহানুভূতির হালকা লেপনে কিছুটা মুছে যাওয়ার সাথে সাথে জোরালো হয়ে উঠছেআকুতির বড় বড়ছোপ, ইতোমধ্যে চোখে জল জমার উপক্রম সমানুপাতেতার কন্ঠে হতাশার মাত্রা এমনভাবে বেড়ে চলে যেন তাতে সমব্যাথী হয়েসুহৃদের মুখ ফুটে বের হয়ে আসা-টেনশন কইরা আর কি কোন লাভ অবো, বারো মুস্কিল তের আসান, খোদায় যা করে মঙ্গলের নিগাই করে, আবার শুরু কইর‍্যা দ্যান দেহি, এই দোকানডাও তো মোটামুটি বালাই চলে, বেবাক ঠিক অইয়া যাব- হরেক রকমের আশার বাণী মূলক কথার ছিটার বিনিময়ে যাতেকরে কারবারে লাখ দুই টাকা মার খাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে যায়
ছেলেটির,ভ্যান হতে পণ্যসামগ্রী বের করতে থাকা, অস্তিত্ব এতক্ষণেও টের পায়নি  দোকানদার- মনোবেদনা উজাড় করার কাজে এতই সে মশগুলঅবশেষে, সুহৃদ ব্যাক্তিটিই তাকে জানিয়ে দিল চ্যাংড়া ছেলেটিরআগমনের খবর স্বাভাবিকভাবে মনে হয়,দোকানদারের কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে ভেবে সুহৃদ ব্যাক্তিটি এখনকার মত উঠে যেতে চাচ্ছে, ব্যাস্ততা কাটলে আবার আসবে সমবেদনা জানাতেবিদায় নেওয়ার জন্য, যাহোক, সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল; আরো কাছে এগিয়ে এসে দোকানদারের পুরু জ্যাকেটের উপর হাত বোলাতে বোলাতে গলার স্বরটাকে আগের চাইতেও বেশ খানিকটা নরম করে আরো কিছু সহানুভূতিসূচক কথাবার্তা বললচলে আসতে আসতে, বার বার মুখ ঘুরিয়ে, যুত করে বেশ কিছু আশার বাণী শোনাতেও ভুললনা সে
দোকানদার করুনভাবে, বিরক্তিসহকারেছেলেটির দিকে চোখ বেঁকিয়ে তাকাল সুহৃদের উঠে যাওয়ার জন্য, এককভাবে তাকেই দায়ী করে বসল সেতবে এই উঠে যাওয়ার পেছনে আরেকটা গোপন কারন আছেযা সহানুভূতি পেতে থাকা লোকটির পক্ষে এই মুহুর্তে হয়ত কল্পনার সুবিস্তৃত আওতার মধ্যেও আনা সম্ভব নয় এবার বেকারী সামগ্রীগুলো একে একে বুঝে নেওয়ার পালা লোকটিরএরপর ছেলেটি অল্প একটু দূরে রাস্তার অপর পাশেমনোহারী কাম চায়ের দোকানের দিকে ভ্যানটিকে চালিয়ে দিল
অপর দোকানটির কাছাকাছি আসতেই ছেলেটি শুনতে পেল ঘর থেকে বের হয়ে আসা চাপা হাসির আওয়াজএই দোকানের একটি ঝাপ খোলা, অপরটি বন্ধ ছেলেটি যখন ভ্যান নিয়ে দোকানের ঝাপ খোলা অংশের সামনে এসে দাঁড়াল তখন দেখতে পেল ঐ দোকানদারের সুহৃদ এবং এই দোকানদার বেশ আমেজ করে সিগারেটের ধোঁয়া ঘরময় ছড়িয়ে দিচ্ছেএবংতাদের সম্মিলিত হাসির শব্দ খানিকটা উচ্চ হতে শুরু করলেই হাসিটাকে মাঝপথে চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলছে, “আস্তে, আস্তে-শ্যুইনা ফালাবো, শ্যুইনা ফালাবো”সুহৃদ ব্যাক্তিটি মাঝে মাঝেই হাসির বেগ কিছুটা কমিয়ে এনে ঐ দোকানদারের দুঃখভারাক্রান্তভাবে কথা বলার ঢং নকল করে,খানিকপূর্বে শুনে আসা কথাগুলো, একটু একটু করে বলে যাচ্ছে- ভাবটি এমন-ব্যাপারটি যেন একঝলকেই ফুরিয়ে না যায়; চাড়িয়ে চাড়িয়ে আরো বেশ কিছুক্ষণ উপভোগ করতে পারে এই কুয়াশাচ্ছন্ন বিষন্ন শীতের সকালে তা যেন খেজুরের মিষ্টি রসের মত!সুহৃদ ব্যাক্তিটির একটি কথা বলা শেষ হতে না হতেই কথাটিকে ছাপিয়েউপচে পড়া উচ্চ হাসির রোল সাথে সাথেই সংক্রামিত হয়ে যাচ্ছে এই দোকানদারের মাঝে উচ্চকিত হয়ে উঠাহাসির বেগ কমিয়ে আনা, দোকানদারের বলা কথার কিছু অংশ বলা, আবার উচ্চ হাসির রোল, আবার হাসিটাকে চেপে ধরা, আবার ফিসফিসিয়ে সাবধান বাণীর উচ্চারণ, মাঝে মাঝে সিগারেটে তীব্র টান এবং উচ্চ হাসির আওয়াজের সাথে জড়িয়ে বিশালাকারে ফাঁক হয়ে থাকা দুই ঠোঁটের মাঝখান দিয়ে ধোঁয়ার ব্যাপকারের নির্গমন।
চ্যাংড়া ছেলেটি, বেশ হতভম্ব হয়ে গেছে, দোকানের ঝাপ খোলা অংশের সামনে দাঁড়িয়ে রইলএর মধ্যেই আমোদে আচ্ছন্ন সুহৃদ ব্যাক্তিটি পাশেই কারো একজনের অস্তিত্বের চুম্বকাকর্ষণ অবচেতনে টের পেয়ে চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দৃষ্টি পতিত হল ছেলেটির মেছতা পড়া বিব্রত মুখের উপর মুহুর্তের মধ্যে সুহৃদ ব্যাক্তিটির মুখ ও ঠোঁট গ্রীষ্মের প্রখর রোদ্রে নেতিয়ে পড়া চারা গাছের মত ঝুলে পড়লজরুরী কাজের অজুহাতে, মাথাটা নুয়ে রাখা অবস্থাতেই, বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল সে হাসি-তামাশা, জমজমাট আড্ডার এমন উষ্ণ পরিবেশ ছেড়ে সুহৃদ ব্যাক্তিটির এই হঠাৎ গোমাড়া মুখ হয়ে উঠে পড়াতে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার খানিকক্ষণ পর ছেলেটির দিকে চোখ পড়ায় দোকানদার ব্যাপারটা যেন আঁচ করতে পারল। তবেদুজনের একজনও ঠিকমত বুঝে উঠতে পারল না- সুহৃদ ব্যাক্তিটি মুহুর্তের মধ্যে কোন দিক দিয়ে বের হয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেলবাষ্পে পরিণত হয়ে যেন পাতলা কুয়াশার মাঝে বিলীন হয়ে গেছে!

অনাদ্য দুঃখ নদী


অনাদ্য দুঃখ নদী
____মিশকাত উজ্জ্বল____

আমার আকাশে পূর্ণিমার মত জোছনাময়ী চাঁদ নেই,
তারা নেই_
জীবনানন্দ দাসের 'সোনালি ডানার চিল'
কুহুকুহু বসন্তের কোকিল
বিরক্তিকর কা কা করার মত দু'একটি কুশ্রী কাক
প্রত্যাখ্যাত প্রেমের পুঞ্জীভূত দহনে অন্তর পুড়ে খাক

আধারাকীর্ণ একাকীত্ব আমায় কুরে কুরে খায়
জীবনের বাঁকে বাঁকে কেবলই না-পাওয়ার দুঃসহ বেদনার স্মৃতি নীরবে কাঁদায়
অন্তরজুড়ে সাহারা মরুভূমির মত সীমাহীন হাহাকার
দুঃখ কুড়াতে কুড়াতে অপস্রিয়মাণ সুখের ভাণ্ডার
কষ্ট সয়ে সয়ে পর্বতবৎ মন
বঞ্চনার তুষারপাতে আচ্ছাদিত ঈশ্বরপ্রদত্ত দেহধন!

হিমালয়ের বরফের মত দুঃখ গলে গলে পড়ছে তাই
আমার হৃদপিণ্ড থেকে নিরবধি...
আমি যেন অনাদ্য দুঃখ নদী

দুই জীবনঃ বস্তুবাস্তবতা, ভাববাস্তবতা


দুই জীবনঃ বস্তুবাস্তবতা, ভাববাস্তবতা
... ... মুহাম্মদ ইউসুফ

একজন লেখক, দার্শনিক, কবি বা শিল্পী শেষ পর্যন্ত কোথায় বাস করবেন ?
নিজের অন্তরজগতে, অন্তর্বাস ?
কবির নির্জনতাকে কি একাকীত্বের স্বেচ্ছানির্বাসনে ফেলা হবে ?
আত্মভুবনে বসবাস কি আত্মমুখিতা ?

জীবনের ছুটাছুটি, রুটিরুজির শ্রম-গ্লানি অন্তরের শূন্যতাকে পূর্ণ করে না ।
পূর্ণতা, স্থিতি চায় অন্তর-আত্মা-মন ।
চায় মিলন ও মুক্তি ।

এ মিলন, স্থিতি ও পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র কিন্তু কেন ?
মৃত্যু কি জীবনকে খণ্ডিত করেছে ? নাকি পূর্ণতা দিয়েছে ?

জীবন আকর্ষনীয় । জীবনে অভাব থাকলেও মোহ আছে, প্রেম আছে, স্নায়ু-সুখ আছে,
উত্তেজনা আছে, উল্লাস আছে ।

কিন্তু তারপরেও কি-যেন-একটা নেই । এই কি-যেন-টা দেশজয়ে, মাটির দখলে,
অর্থ- বিত্তে, আপাত ক্ষমতার দাপটে, ভোগসুখে পাওয়া যায় না । এখানেই
মানুষের অপূর্ণতা, শূন্যতা, একাকীত্ব । এই অপূর্ণতা, শূন্যতা, একাকীত্ব
অধিকাংশ মানুষই অতিক্রম করতে পারে না ।

মানুষের মুক্তির, স্থিতির, পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা কীযেননেই-টাকে অর্জন করার লক্ষ্যে ।
জ্ঞানীমাত্র এই সত্যটা তীব্রভাবে উপলব্ধি করেন ।

আমরা কোথায় ছিলাম ?
যেখানে ছিলাম সেখানে স্থিতি ও শান্তি ছিল নিশ্চয়ই ।
এটা একারণে বলছি যে,
স্থিতি ও শান্তির অভাবটা এখানে (পৃথিবীতে) এসে বুঝতে পারছি ।
আমি অভাবী । আমার খাদ্যের প্রয়োজন ।
জীবনধারনে আমাকে দৌড়াতে হয় । চাকুরি, ব্যবসা করতে হয় ।
আমাকে তাড়না দেয়া হয়েছে । বাধ্য করা হয়েছে ।
অবশ্য জীবনধারনে আনন্দ নিশ্চয়ই আছে, ফলে শ্রম গায়ে লাগে না, মনে লাগে না ।
ক্ষুধা নিবারণে রসনার তৃপ্তি আছে । সহধর্মিনীর প্রেমে যাদু আছে ।

কিন্তু মনের শূন্যতা ?
কি-যেন নেই । কি-যেন নেই । কি-যেন চাই । কি-যেন চাই ।

এখানেই রহস্যটা । এই রহস্যটা নিয়েই নোবেল বিজয়ী আফ্রিকান ঔপন্যাসিক নাদিন
গার্ডইমার বলেছেন, ‘ আমার মধ্যে যে প্রকৃতিগত কল্পনাশক্তি রয়েছে তার
মাধ্যমে যে সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটবে তা কিন্তু আমার বাস্তব জীবন থেকে
আলাদা হবে । একজন লেখককে প্রকৃত আন্তরিক বিস্ময় নিয়ে পৃথিবীকে দেখায়
অভ্যস্ত হতে হবে ।

এটি কেন ?
এটি একারণে যে, জ্ঞানীমাত্র জীবনের গ্লানিকে পাশ কাটাতে চান । জ্ঞানীগণ
হাঁসের মত জীবনযাপন করেন । হাঁস পানিতে সাঁতার কাটে কিন্তু তীরে এসে
গাঝাড়া দিয়ে ময়লা পানি, আবর্জনা ফেলে দেয় । এইযে ধরি মাছ নাছুঁই পানি‘ –
এটার প্রয়োজন আছে । এই প্রয়োজনীয়তা প্রকৃতিগত । তা নাহলে মোহের পাঁকে
অন্ধগলিতে জীবনবাস হবে । সত্যভুবনে প্রবেশ করা যাবে না ।

বাস্তব জীবন থেকে আলাদাযে সৃজনশীলতার জগত, যে বোধের জগত, মননের জগত,
চিন্তার জগত, চিন্তাভ্রমণের জগত এটিই প্রকৃত জগত । এই সত্যজগতটিতে
একমাত্র মানুষেরই প্রবেশাধিকার, অন্য কোনো প্রাণীর প্রবেশাধিকার নেই,
দেয়া হয়নি ।

এইযে বাস্তবজীবনে ( পার্থিব জীবনে ) বসবাস করেও অন্যভুবনে, অন্যজগতে
বসবাসের তীব্র আকাঙ্ক্ষা – ‘হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোনোখানে’ – অন্য
কোনো লোকে, জগতে বসবাসের আগ্রহ এবং অন্যজগতে বসবাসের আকাঙ্ক্ষায় স্থিতি,
মুক্তি ও শান্তিলাভের চিন্তা ও প্রবল আগ্রহ এটাই প্রমাণ করে যে, আমরা
আসলে অন্যজগতে ছিলাম এবং যখন, যে সময়ে অন্যজগতে ছিলাম তখন দুশ্চিন্তা ছিল
না, অভাব ছিল না, অভিযোগ ছিল না । শান্তিতে, নিরাপদে ছিলাম ।

তাহলে আমরা কি দেখলাম, বুঝলাম ?

ক।
শান্তি, স্থিতি ভঙ্গ হয়েছে ।
খ।
অভাবে পড়ে গেছি ।
গ।
বিচ্ছিন্ন হয়েছি ।

হ্যা, বিচ্ছিন্নতাই মূল সমস্যা ।
মানবজীবনের, মানবাত্মার মূলসমস্যা এই যে, মানবাত্মা পরমাত্মা থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়েছে । যখন সে (মানবাত্মা ) পরমাত্মায় ছিল, কোনো সমস্যা ছিল
না ।
তাহলে এই সিদ্ধান্তে আসতেই হয় যে, সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে ।

অন্তরের, আত্মার শূন্যতা ও একাকীত্ব ঘুচাতে যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে
নোবেল বিজয়ী ওকতাভীও পাজ-এর মতো আমাদেরকে ক্রমাগত ধারাবাহিকভাবে সারাজীবন
ধরে একথাটি বলে যেতে হবে – ‘মানুষ কখনও একাকীত্ব অতিক্রম করতে পারে না
কথাটি শূন্যতা অতিক্রমকিংবা একাকীত্ব অতিক্রমবলা ঠিক হবে না ।
কথাটি হবে – ‘বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করাঅর্থাৎ পরমকে পাওয়া, পরমের (
আল্লাহ্‌র ) সান্নিধ্যলাভ, নৈকট্যলাভ । এখানে একটি বিষয় খুবই
গুরুত্বপূর্ণ । আল্লাহ্‌র নৈকট্যলাভ বা সান্নিধ্যলাভে
পরমাত্মায় ( অর্থাৎ আল্লাহ্‌ পাকের জাতসত্ত্বায় ) সম্পূর্ণ বিলীন হওয়ার
( ফানা হয়ে একেবারে মিশে যাওয়া ) ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল, অলীক উদ্ভট
কল্পনা । কারণ, পরমাত্মা ( আল্লাহ্‌ ) তাঁর এক ও একক সার্বভৌমত্ব ও
মহাপরাক্রম জাতসত্ত্বা নিয়ে আছেন । মহান আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞানী,
সর্বশক্তিমান ও সর্বশ্রোতা । আমরা সর্বমহান আল্লাহ্‌র নিকট থেকে এসেছি
এবং সর্বজ্ঞানী আল্লাহ্‌র নিকটেই ফিরে যাচ্ছি । এটি চরম সত্য ।

আল্লাহ্‌র নৈকট্যলাভ বা সান্নিধ্যলাভে স্বস্তি-সুখ-শান্তি-নিরাপত্তা
অবশ্যই পাওয়া যাবে । এই নিরাপত্তাবোধ পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মনের গভীরে
নেই । দৃঢ়বিশ্বাস ( প্রতীতি ), জ্ঞানের গভীরতা, অটলতা-দৃঢ়তা না থাকার
কারণে বেশীরভাগ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, একাকীত্ব অতিক্রম করতে পারে
না । ফলে মানবজীবন ( সাধারণ মানুষের জীবন ) শেষপর্যন্ত শূন্যতা ও
একাকীত্বের লক্ষ্যহীন বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে ।

কূটনীতি, দেশদখল, ভোট, দেশাত্ববোধ, জাতীয়তাবোধ, ভাষাবোধ ইত্যাদি যে
আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নিয়েছে তাহলো একসাথে, একযোগে থেকে পার্থিব জীবনের
সমস্যা সমাধানের জন্যে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসমাত্র ।

কিন্তু মানবমনের মূলসমস্যা বিচ্ছিন্নতাবোধের সমস্যা ।
কূটনীতি, পরমাণু গবেষণা, ভোট, দেশাত্ববোধ, জাতীয়তাবোধ, ডলার-পাঊণ্ড, তেল,
বুলেট, রাজনীতি, কম্পিউটার, মহাকাশ গবেষণা, মিসাইল দিয়ে মানবমনের
মূলসমস্যা বিচ্ছিন্নতাবোধের সমস্যার সমাধান হবে না ।
অস্তিত্ব রক্ষার্থে ( মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত ) তেল-আলুর প্রয়োজন । কিন্তু
শুধুমাত্র তেল-আলুতে মন ভরে না ।

পাগল মন, মনরে, মন কেন এত কথা বলে ... মন এতকথা একারণে বলে মন,
আত্মা যে পরমাত্মার ( আল্লাহ্‌র ) নিকট থেকে থেকে এসেছে সেই পরমাত্মা (
আল্লাহ্‌ ) অনেক কথা বলেন । মহাপবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন মহান আল্লাহ্‌রই
কথা । যেহেতু পরমাত্মা ( আল্লাহ্‌ ) অনেক কথা বলেন, সেহেতু আমরা যারা
পরমাত্মা ( আল্লাহ্‌ ) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি আমরা তো আরও বেশি কথা বলব !!
আমাদের তো দুঃখকষ্ট, যন্ত্রণা আরও বেশি । বাজার করতে হয় আমাদের, বিরূপ
আবহাওয়া মোকাবেলা করতে হয়, রোগবালাই আছে, রুটিরুজির জন্যে অধিকাংশ
মানুষকে জীবনের বেশীরভাগ সময় ব্যয় করতে হয় ।

আমরা ( মানুষ, মানবাত্মা ) পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি । একারণেই
আমাদের মন সারাক্ষণ বিরহী, মিলনের তীব্র আকাঙ্ক্ষী । [ পাগল মন বলা ঠিক
নয়, কারণ, বিচ্ছিন্ন মন-আত্মা মূল পরমআত্মার ( আল্লাহ্‌র ) কাছাকাছি
থাকতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক, মন-আত্মার এই আকাঙ্ক্ষা খুবই স্বাভাবিক,
তাই মনকে পাগল বলা হলো অজ্ঞতা, মূর্খতা ]

বিচ্ছিন্ন কেন করা হলো ?
লক্ষ্য কি ? কারণ কি ?

কারণ এই যে, আল্লাহ্‌ প্রকাশিত হতে চেয়েছেন । সৃষ্টির কারণেই আল্লাহ্‌র
সকল গুণাবলী প্রকাশিত হয়েছে । মোমিনের কলবের আয়নায় আল্লাহপাক নিজেকে
প্রকাশিত-প্রতিফলিত দেখতে চেয়েছেন । মোমিনের (দৃঢ়-অটল বিশ্বাসী আমলকারি
মুসলিম [প্রেকটিসিং মুসলিম]) কলবে ( আত্মা-আয়নায় ) আল্লাহ্‌ প্রকাশিত
-প্রতিফলিত । আল্লাহ্‌কে মানবীয় চামড়ার চোখে দেখা অসম্ভব । মোমিনগণ কলবের
আয়নায় ( আত্মার আয়নায় ) আল্লাহ্‌কে উপলব্ধি করেন, শুকরিয়া আদায় করেন (
ধন্যবাদ দেন ) এবং স্থিতি-শান্তি-নিরাপত্তা লাভ করেন ।

মানবাত্মার স্থিতি-শান্তি- নিরাপত্তা লাভের এই একটিই উপায়-পদ্ধতি ।
অর্থাৎ মহান আল্লাহ্‌র নিকট আত্মসমর্পণ করা ।

মানবাত্মা-পরমাত্মার এই রহস্যই জীবন ।
এই জীবনরহস্যরসে বিস্ময়েআনন্দে মেতে থাকাই, ডুবে থাকাই জীবনের একান্ত,
প্রকৃত আস্বাদন এবং অবশ্যই তা ভাববাস্তবতার চিন্তাভ্রমণে । হেথা নয়,
হোথা নয়, অন্য কোনোখানে’ – এই অন্য কোনোখানেটা মূলে, বিরহে, এবং যুগপৎ
মিলনে । পরমাত্মা আল্লাহ্‌কে খুঁজতে, কাছে পেতে মানুষকে যেমন প্রকৃতিকে (
নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ) পাঠ করতে হয় ( গবেষণা করতে হয় ), তেমনি আত্ম-পাঠ
অর্থাৎ নিজেকেও পাঠ করতে হয় । নিজেকে চেন, তাহলে আল্লাহ্‌কে চিনতে
পারবে। এভাবেও বলা যায় – ‘আল্লাহ্‌কে চেন, তাহলে নিজেকে চিনতে পারবে

বিষয়টি অত কঠিন কিছু নয় । আন্তরিকতার সাথে গভীর মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলেই
হয় । কারণ, মহান স্রষ্টা আল্লাহ্‌পাক তাঁর স্বভাবেই আমাদেরকে সৃষ্টি করে
এখানে ( পৃথিবীতে ) পাঠিয়েছেন । ফলে মনটা-আত্মাটা নির্মল,
পবিত্র, মোহমুক্ত থাকলে তাঁকে ( আল্লাহ্‌কে ) নিজের ভিতরই উপলব্ধি
করা যায় ।

আফ্রিকান ঔপন্যাসিক ( নোবেল বিজয়ী ) নাদিন গারডিমার বলেছেন, ‘সৃজনশীলতা
বাস্তব জীবন থেকে আলাদা হবে এবং একজন লেখককে আন্তরিক বিস্ময় নিয়ে
পৃথিবীকে দেখায় অভ্যস্ত হতে হবে’ – একথাটির মৃদু সংশোধন প্রয়োজন । কথাটি
আসলে হবে সৃজনশীলতা বস্তুজীবন থেকে আলাদা হবে । বস্তুজীবনও কিন্তু
বাস্তবজীবন । বস্তুজীবনকে অস্বীকার কিংবা একেবারেই বাদ দেয়া যেহেতু যায়
না, সম্ভব নয় বলেই এটি অবশ্যই পার্থিব জীবনের সীমাবদ্ধতা যেটি কবি
ইকবাল বলেছেন ।

বস্তুজীবনও বাস্তবজীবন এবং ভাবজীবন বা চিন্তাভ্রমণের জীবনও বাস্তবজীবন ।
এই দুইজীবনের বৈপরীত্য বা সংঘর্ষই জীবনের গ্লানির কারণ, একঘেয়েমির কারণ ।

অবশ্য, গর্দভ-মূর্খ ধরনের মানুষ জীবজীবনই কাটিয়ে দেয় সমগ্র জীবনসময়ে ।
বস্তুজীবনে, স্নায়ুজীবনে, ভোগজীবনে তুষ্ট থাকে, খায়-দায়-ল্যাদায় ।
ভাবজীবনের, সত্যজীবনের সত্যজগতের আনন্দসংবাদ পায় না, সত্যজগতের (
আল্লাহ্‌ময় জগতের ) আনন্দভ্রমণে যেতে পারে না । অবশ্য বিপদে-আপদে পড়লে
তারা আল্লাহ্‌কে ডাকে, বিপদ কেটে গেলে আবারও জীবজীবনে বসবাস শুরু করে ।

বিস্ময়কর ও দুঃখজনক সংবাদ এই যে, গর্দভ-মূর্খ ধরনের মানুষের জঙ্গলই দুনিয়াজোড়া ।

ভাববাস্তবতার বিষয়টি পৃথিবীতে কম আলোচিত হয় । মানুষ জীবন নিয়ে দৌড়াদৌড়ি
করে, হাইজাম্প, লংজাম্প দেয় একসময় বৃদ্ধ হয় । মৃত্যুর আগে একটুআধটু
চিন্তা হয়, ভয় হয় ।
তখন দুর্বল মস্তিষ্কে, দুর্বল স্নায়ুতে আর কতটুকু সংবেদনশীলতা থাকে ?
সত্যজগতে প্রবেশের সাধনার সময় তখন থাকে না । সময় গেলে সাধন হবে না’ –
লালন । তাছাড়া দীর্ঘ জীবনাচার ( অভ্যাস ) তাকে ঘোর’-এ রাখে । অবশেষে – ‘
আইলাম আর গেলাম, পাইলাম আর খাইলাম, দেখলাম-শুনলাম কিছুই বুঝলাম না

পৃথিবীব্যাপী ভাববাস্তবতার উর্বর চাষাবাদ করা গেলে ৭০০ কোটি মানুষের এই
পৃথিবী সম্পূর্ণ অন্যরকম আনন্দময় হতো । যা নিউ মিলেনিয়ামের মানবসম্প্রদায়
কল্পনা-ধারণা করতে পারছে না ।

ভাববাস্তবতার জীবন এক জ্যোতির্ময়-আনন্দময় শক্তিশালী জীবন ।
এজীবনে হতাশা নেই, ক্ষয় নেই, গ্লানি নেই, ভয় নেই । আছে স্থিতি ও নির্ভরতা
আছে শান্তি-শোকর-আনন্দ । শূন্যতার হাহাকার নেই, অভিযোগ নেই, অভাব নেই ।
পরিপূর্ণ এক মানবজীবন ।
ভাববাস্তবতাই চরম ও পরম বাস্তবতা ।
বস্তুবাস্তবতাকে অস্বীকার করে নয়, পূর্ণ পাশ কাটিয়ে নয়, বস্তুবাস্তবতাকে
ব্যবহার করেই, বস্তুবাস্তবতার ঘোড়ায় চড়েই ভাববাস্তবতার
জ্যোতির্ময়-আনন্দময়-আলোকিত জগতে/জীবনে বসবাস করতে হবে এখানে ( পৃথিবীতে )
থেকেই । তাহলেই আলোকিত জীবন, তাহলেই সার্থক মানবজীবন । তাহলেই বিপদে
মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থনা’ – তাহলেই আত্মা-পরমাত্মায় (
মানবাত্মার সাথে মহান সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহ্‌র মিলন ) মিলন
তাহলেই স্থায়ী আনন্দবাস ।